'জ্বালানি এবং পরিবেশ বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা' হিসেবে প্রকাশিত হওয়ায় এবারের সাময়িকীতে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রবন্ধের সংখ্যাই বেশি। আধুনিক জীবনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমরা চারপাশের পরিবেশের কি পরিবর্তন করে ফেলছি, পরিবেশের ক্ষতির মাত্রা কত, পরিবেশের উপর ক্ষতিকর কার্যক্রম কিভাবে কমিয়ে আনা যায় ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কটি মূল্যবান প্রবন্ধ রয়েছে 'প্রযুক্তি কথন' ই-পত্রিকায়। চৌম্বকীয় ও আকর্ষণকারী সূচিপত্রটি হলো:
১। শক্তির উৎস, কিছু প্রাক-কথন'শক্তির উৎস, কিছু প্রাক কথন' নামক প্রবন্ধে শক্তির উৎস সন্ধানে মানুষের যে চেষ্টা তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হযেছে। লেখক শাহরিয়ার তারিক অল্প কথায় যুগে যুগে মানুষের শক্তি ব্যবহারের পদ্ধতি, সমস্যা ও তা থেকে সমাধানে উত্তরণ ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। পেশী শক্তি থেকে আগুন, তারপর বায়ুশক্তি, পশুশক্তি, কয়লা শক্তি, বাষ্পীয় শক্তি ব্যবহার শেষে মানুষ এখন বিদ্যুৎ শক্তিতে বেশি নির্ভর। কিন্তু এই বিদ্যুৎ শক্তি পেতে মানুষকে যে পরিমাণ মূল্য দিতে হচ্ছে তার মূল্য অপরিসীম। পরিবেশের ক্ষতিকারক জৈব জ্বালানীর কথাও লেখক প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছেন। শক্তির উৎস হিসেবে আরও উন্নত জ্বালানী ব্যবহারের জন্য মানুষের নিত্যনতুন আবিষ্কারের উন্মাদনা তা এখনই থেমে যাওয়ার নয়। কারণ পারমাণবিক শক্তিও আমাদের ভোগবাদীতার শক্তিকে তৃপ্ত করতে পারছেনা।
২। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উপর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রভাব
৩। অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবশে দূষণ এবং আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
৪। "গ্রাম্য চাষা'-দের বিদ্যুৎ উৎপাদনের গল্প
৫। জৈব জ্বালানী: সম্ভাবনা, নাকি সংকট
৬। মেধাসত্ত্ব সংরক্ষণ - আমাদের করণীয় কি হবে?
৭। ইন্টারনেট প্রজন্ম
৮। ওয়্যার হাউস এপ
৯। গিট: অসাধারণ একটি সোর্স কোড ম্যানেজমেন্ট টুল
১০। উইন্ডোজ সার্ভার ২০০০/২০০৩ এ এক্টিভ ডিরেক্টরি
১১। উবুন্টু যে কারণে উইন্ডোজ নয়
১২। পথচারী
মূল রচনা হল বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ হুসাইনুজ্জামানের "পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উপর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রভাব" প্রবন্ধটি। নাম দেখেই রচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের কি ধরণের পরিবর্তন করে ফেলি সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এই দীর্ঘ প্রবন্ধটির মূল বিষয়। লেখকের ভাষায়:-
পরিবেশ বলতে মূলত বাস্তুতন্ত্রকে (Ecology) বুঝানো হয়েছে। পরিবেশের অন্যান্য অংশসমূহ, যথা: সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নান্দনিকতা ইত্যাদিকে এই বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এই বিশ্লেষণে গৃহে ব্যবহৃত খুব ছোট ছোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত যে বিষয়গুলি/ পদ্ধতিগুলি আলোচনায় স্থান পেয়েছে তা হল:প্রতিটি পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ভূমি ও বায়ুমন্ডলের কিরকমের ক্ষতি হয়, তার ফলে পরিবেশের তথা জীবজগতের উপর কি প্রভাব পরে তা লেখক স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। জলজ বাস্তুতন্ত্রও যে জোয়ার-ভাটার শক্তির সাহায্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরূপ প্রভাবের শিকার তা লেখক বলতে ভুলে যাননি। শেষের পদ্ধতিটি আসলে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প কি হতে পারে তাই এই অংশের আলোচ্য বিষয়। পরিবেশের কোনরকম ক্ষতি না করে, অন্যান্যগুলোর প্রভাবের সাথে তুলনা করে কিছু কম ক্ষতিকারক শক্তি ব্যবহারের পদ্ধতি কি তা এই অংশের আলোচ্য বিষয়। যেমন: শক্তি সাশ্রয়ী বাতি, ভবনসমূহের তাপ ও বায়ুনিরোধী ব্যবস্থা উন্নয়নকরণ, পুরাতন যন্ত্রপাতি এবং কারখানাকে প্রতিস্থাপন করা, বিদ্যুৎ চাহিদাকে পুনর্বিন্যস্তকরণ, সঞ্চয়ী হিটার ইত্যাদি পদ্ধতিতে আমরা শক্তি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি কিছুটা হলেও কমাতে পারি। লেখকের ভাষায়:
১. জীবাশ্ম জ্বালানী দহন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন
২. জলবিদ্যুৎ
৩. বায়ুশক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন
৪. জোয়ার-ভাটার শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন
৫. সৌরবিদ্যুৎ
৬. আনবিক চুল্লীর দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন
৭. ভূ-গর্ভস্থ তাপের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন
৮. নেগাওয়াট পদ্ধতি (বিদ্যুৎসাশ্রয়)
বিদ্যুৎ উৎপাদনে আপাতদৃষ্টিতে যতটুকুই খরচ মনে হউক না কেন এর ফলে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সেগুলোর ক্ষতির পরিমান অনেক ক্ষেত্রেই অনেক বেশি হয়। কিছু কিছু ক্ষতি আছে যা অপরিবর্তনীয়। তাই সভ্যতার জন্য অপরিহার্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় তুলনামূলক বিচারে কম ক্ষতিকারক (সরাসরি খরচ এবং পরিবেশের মূল্য) প্রভাব সম্পন্ন বিষয়টা বেছে নেয়া জরুরী। অনেক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে দূরবর্তী স্থানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমদানী করার সময় পরিবেশের উপর বিদ্যুৎ পরিবহন তার/ টাওয়ারগুলোর বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টাও বিবেচনায় আনতে হবে।'অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবেশ দূষণ এবং আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা' শিরোনামের প্রবন্ধটিতে ফাহমিদা ইয়াসমিন সময়ের সাথে সাথে নগরায়ন আমাদের জীবনকে কতটুকু দূষিত করে তুলেছে। গ্রাম এবং শহরের পার্থক্য আলোচনা করতে গিয়ে লেখকের সমাজ সচেতন মনটি আর আড়ালে থাকে না। ক্রমাগত শহরমুখীতা, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বাড়িঘর, হাট-বাজার, শিল্পকারখানা, অফিস-আদালত পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলেছে। লেখকের বর্ণনায়:
অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত বাড়িঘর, দোকানপাট, বৃদ্ধি পাচ্ছে যানবাহন, গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা। অধিকাংশ শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে নদীগুলো ক্রমশঃ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ড্রেজিংয়ের অভাবে নদীগুলো তার নাব্যতা হারাচ্ছে। প্রতিবছর অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। যেগুলোতে পানি আছে তাও প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী। নাব্যতা হারানোর ফলে দেশের মৎস্য সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া শিল্প কারখানার বর্জ্য শুধু নদী ভরাট করছে তা নয় সেই সাথে পানি দূষিত করছে এবং পানি দূষণের কারণে কৃষি জমি, মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশেরও ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি রিপোর্ট মতে, পরিবেশের দূষণের ফলে ঢাকার পানির মান নষ্ট হয়ে যাওয়া, বায়ু দূষণ এবং নদী ও জলাশয়ের মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা জিডিপির ২.৭ শতাংশেরও বেশি।এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই। পৌর এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকাভেবেদ আবর্জনার প্রকারভেদ বিভিন্নরকম। কোনটি পচে যায়, কোনটি আবার অপচনশীল। কোনটি আবার পুনর্ব্যবহারযোগ্য। লেখক বিভিন্ন চার্ট দিয়ে বাংলাদেশের বর্জ্য সম্পর্কে বিভিন্নরকম তথ্য উপাত্ত পরিবেশন করেছেন। পরিবেশের উপর বর্জ্যের বাড়তি প্রভাব কি সে বিষয়ে একটি তথ্যবহুল অংশ রয়েছে এই প্রবন্ধটিতে। দীর্ঘ এই প্রবন্ধটিতে বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বর্তমান অবস্থা, সম্ভাবনা ইত্যাদির বাস্তব চিত্র তুলে ধরে লেখক কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাবগুলো বর্তমান বিশ্বের আধুনিক রাষ্ট্রগুলো অনেক আগে থেকেই মেনে চলছে। কিন্তু আমাদের সামগ্রিক আর্থ সামাজিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব কবে যে বিবেচিত হবে, তা চিন্তার বিষয়।
শাবাব মুস্তাফা জার্মানীর এক গ্রামের কৃষকদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্যর কাহিনী তুলে ধরেছেন তার "গ্রাম্য চাষাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের গল্প" নামক নিবন্ধে। জার্মানীর পূর্ব উপকূলের কৃষি প্রধান ছোট্ট একটা গ্রাম্য শহর ফাইয়াম। এখানকার অধিবাসীরা বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদর প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করছে। শুধু তাই নয় তারা উদ্বৃত্ত ১৭% বিদ্যুৎ যোগান দিচ্ছে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে। ফাইয়াম গ্রামের কৃষকদের এই সাফল্য এসেছে প্রধানত সচেতনতা থেকে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এটা তাদের এক সচেতন গণজাগরণ। তারা বিদ্যুৎ কিনে নয় নিজেরাই উৎপাদন করে গ্রামের অর্থনৈতিক ভাগ্য পাল্টে দিয়েছেন। নবায়নযোগ্য শক্তি ও পরিবেশ বান্ধব শক্তি দিয়ে তারা তৈরি করছে প্রয়োজনীয় সবটুকু বিদ্যুৎ।
সেখানে গত বছর ফাইয়ামে উৎপন্ন হয়েছে ১৪.৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ যা এর নিজের চাহিদা থেকে ২.১ কিলোওয়াট ঘন্টা বেশি। এই অতিরিক্ত বিদ্যুতে জার্মানির কমপক্ষে ৬০০ বাড়িতে আলো জ্বলেছে। ফাইয়ামের এই নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে ফাইয়ামের হিরো মি. লাইমারের বক্তব্য বেশ সোজাসাপ্টা,
"এরকম বহুলোক আছে যারা জানে যে পরিবেশ রক্ষার জন্য তাদের কিছু না কিছু করার আছে কিন্তু কাজের বেলায় কেউই কিছু করে না। এই ব্যাপারে আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা এখানে যা করেছি, তা শুধু আমাদের পরিবেশ আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই করিনি, সেইসাথে নিজেদের জন্যও করেছি"
"জৈব জ্বালানী: সম্ভাবনা, নাকি সংকট?" নামক প্রবন্ধে বিপ্র রঞ্জন ধর জৈব জ্বালানীর সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন। জৈব জ্বালানীর শুধুমাত্র নেতিবাচক দিক নয় কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বিপ্র রঞ্জন ধরের আলোচনায় এই বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। উইকিপিডিয়া, ন্যাশনাল বায়োডিজেল বোর্ড, বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা তথ্য দিয়ে লেখক বলেছেন যে জৈব জ্বালানীর বিকল্প উৎস রয়েছে, আর তা ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা পরিবেশের ক্ষতি করার পরিমাণ আশাতীত পরিমানে কমিয়ে আনতে পারি।
এই ই-ম্যাগাজিনের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হল অভ্র নীল এর লেখা "উবুন্টু যে কারণে উইন্ডোজ নয়" শীর্ষক লেখাটি। লিনাক্স নিয়ে মানুষের অনেক অনেক অভিযোগকে খুব সহজে সাবলীল ভাষায় আলোচনা করা হযেছে। লিনাক্স ব্যবহার করতে গিয়ে আমাদের ঠিক কোন ধরণের মানসিকতা তৈরি করতে হবে, কি ধরণের মূল্যবোধ তৈরি করা প্রয়োজন, তা সংক্ষেপে সুন্দর করে মনোজ্ঞ বিষয়ের উদাহরণ দিয়ে লেখক বর্ণনা করেছেন। কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে সামান্য হলেও চিন্তা করে এমন যে কারও জন্য এই লেখাটিকে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে সুপারিশ করবো।
সব শেষের হুমায়রা হারুনের লেখা "পথচারী" নামের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীটির উল্লেখ না করলেই নয়। এক অন্য ধরণের স্বাদ এই গল্পটি পাঠ করে আমি পেয়েছি। প্রচলিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর চাইতে এই গল্পটি অন্যরকম। লেখকের গল্প বলার ভঙ্গীটিও অসাধারণ। পড়তে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি এ কথা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি।
৯০ পৃষ্ঠার ই ম্যাগাজিনটির সাইজ মাত্র ১.২৩ মেগাবাইট।
- ডাউনলোড লিঙ্ক ০১ (File type: 7z File. Size: 1.1 MB)
- ডাউনলোড লিঙ্ক ০২
- ডাউনলোড লিঙ্ক ০৩
সৃজনী সাধারণ লাইসেন্স ৩.০ এর আওতায় প্রকাশিত এই সাময়িকীটির যে কোন ধরণের অবাণিজ্যিক বিতরনের অনুমতি রয়েছে।