এই খবর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো পত্রিকার ২৪ অক্টোবর তারিখে। লিখেছেন: মুহম্মদ আরিফিন সন্ধি
মাত্র কয়েক দিন আগেই শেষ হলো জার্মানির বিখ্যাত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। বইপ্রেমীদের কাছে এই মেলার আবেদন অনেকখানি। তবে এবারের মেলায় শুধু কাগজের বই নয়, বরং কাগুজে বইয়ের পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক বইয়েরও দেখা মিলেছে। এ ইলেকট্রনিক বইগুলো আবার সাধারণ বইয়ের মতো পাতা উল্টে পড়া যায় না; এর জন্য দরকার পড়ে বিশেষ প্রযুক্তিসংবলিত যন্ত্রের বা ই-রিডারের। পড়ার ইলেকট্রনিক এই যন্ত্রগুলো এবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় সাধারণ বইয়ের পাশাপাশি প্রচুর চোখে পড়েছে। মেলার দর্শনার্থীরা এরই মধ্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে সাধারণ বইয়ের পাশাপাশি অচিরেই একটি জোরদার যুদ্ধ বেধে যাবে ই-রিডার বা ইলেকট্রনিক বইয়ের।
বর্তমান সময়ে ই-রিডারগুলোর কাটতি ব্যাপক। আমাজনের কিন্ডল এবং বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান সনির রিডারের চাহিদা যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি এর পাশাপাশি তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত প্রোটোটাইপ নিয়ে এ ব্যবসায় চলে আসছে। এরই সঙ্গে বইয়ের প্রকাশকেরা তাঁদের বইগুলোর ডিজিটাল আকার দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক দুর এগিয়ে গেছেন।
ই-রিডারগুলোর জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে এগুলো যেমন ছোট এবং হাতব্যাগে বহন করার মতো হালকা, তেমনি ব্যাগে পড়ার জন্য একগাদা বই কিংবা সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। আর কিছু ই-রিডারে ইন্টারনেটে শব্দসন্ধানের পাশাপাশি তারবিহীন সর্বাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা ওয়াইফাই সংযোগ বিদ্যমান। কারও কারও মতে, এ ধরনের ই-রিডার অচিরে অ্যাপলের আইপড যেমন ডিজিটাল সংগীতের জগৎ করায়ত্ত করেছে, তেমনি ডিজিটাল অক্ষরকে মুঠোয় পুরবে। বিখ্যাত পেঙ্গুইন প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী জন ম্যাকিনসন বলেন, ‘বর্তমানে এ ধরনের ই-রিডারগুলো বিশেষ কোনো শ্রেণীর প্রযুক্তিপ্রেমীর ব্যবহার্য বস্তুর তালিকা থেকে মূলধারার পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে।’ ম্যাকিনসন আরও জানান, পেঙ্গুইন এখন থেকে তার সব বইয়ের কাগুজে সংস্করণের পাশাপাশি এ ধরনের ই-রিডারে পড়ার উপযোগী সংস্করণ বের করছে।
মেলার দর্শনার্থীরা অনেকেই জানান, আগে ধারণা ছিল, এ ধরনের ই-রিডার মূলত বিজ্ঞানীদের উপযোগী এক ধরনের বই পড়ার যন্ত্র। কিন্তু ক্রমেই সে ধারণা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। কারণ, এরই মধ্যে পর্যটক, শিক্ষার্থীদের কাছে পড়ার এই যন্ত্র যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। মেলায় সাধারণ ই-রিডারের পাশাপাশি বেশ কিছু অভিনব মডেলও এসেছে। এর মধ্যে ডাচ্ নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান পলিমার ভিশন রেডিয়াস নামের একটি প্রোটোটাইপ ই-রিডার সংস্করণ নিয়ে এসেছে, যা ভাঁজ করা যায়।
বিশ্লেষকদের মত
প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসাপ্লাইয়ের মতে, ই-বই বাণিজ্য ২০০৭ সালে ছিল মাত্র ৩৫ লাখ ডলারের; সেখানে ধারণা করা হচ্ছে, ২০১২ সাল নাগাদ এই ব্যবসা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২৯ কোটি ১০ লাখ ডলারে! যদিও ই-রিডার পুরোপুরি চালু না হতেই এর ভালোমন্দ, সাফল্য, সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক জমে উঠেছে। জার্মানির বই প্রকাশনা শিল্পের একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এমভিবির প্রধান রোনাল্ড শেইল্ডের মতে, ই-বই কখনোই ছাপানো বইয়ের জায়গা দখল করতে পারবে না। তবে এর কিছু সুবিধা জনপ্রিয়তা পাবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমার সন্তানেরা এখনো ছবি দেখে ছাপানো বইয়ের পাতায়। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই তারা পাঁচ কেজি (১১ পাউন্ড) বইয়ের ঝোলা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাবে কি না।’
পরিবেশবাদীরা অবশ্য ই-বইকে স্বাগত জানিয়েছেন দুটি কারণে−প্রথমত, এতে শক্তির ব্যবহার অনেক কম এবং দ্বিতীয়ত, এ ধরনের বইয়ের ব্যবহারে কাগজের ওপর থেকে চাপ কমবে।
তবে অর্থনৈতিক সংকট এ ধরনের প্রযুক্তিপণ্য বিক্রি কমিয়ে দেবে বেেল ধারণা করছেন ইউরোপিয়ান বুকসেলার ফেডারেশনের পরিচালক ফ্যাঙ্কুয়েস ডুবরুলি। আবার কারও কারও ধারণা, এ ধরনের বই পড়ার যন্ত্রের চেয়ে মুঠোফোনের পর্দা ডিজিটাল লেখা পড়ার একটি ভালো মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। আর মুঠোফোন এরই মধ্যে বেশির ভাগ মানুষের কাছে আছে এবং এটি সহজে ইন্টারনেটে যুক্ত হতে পারে।
আগামী দিনের বই!
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরিচালক জুয়েরগেন বোশ বলেন, ‘এরই মধ্যে আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বই প্রকাশকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা মুঠোফোনে পড়ার উপযোগী করে বই প্রকাশের পরিকল্পনা করছেন; কারণ, সেখানে সবার কাছে মুঠোফোন আছে। আর ই-বুক রিডারের প্রতিটির দাম পড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার, যেখানে এই পণ্যের কোনো বাজার নেই বললেই চলে।’
উল্লেখ্য, জাপানে কিছু ছোটগল্প চালু হয়ে গেছে, যেগুলো পাঠক তার মুঠোফোনের পর্দায় পড়তে পারবে ইনস্টল করার পর। অন্যদিকে অ্যাপলের আইফোন তার ব্যবহারকারীদের মুঠোফোনে উপন্যাস পড়ার সুবিধা দিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই।
তবে এ ধরনের যন্ত্রোপযোগী বই পড়ার পাঠক যে দিন দিন বাড়ছে, তার সঙ্গে সুর মেলালেন মার্কিন প্রকাশকদের সংগঠনের কপিরাইট কমিটির প্রধান অ্যালান অ্যাডলার। তিনি বলেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলেই এখন ইন্টারনেট থেকে সহজে আপনার কাছে থাকা ডিজিটাল যন্ত্রের উপযোগী পাঠ্য কোনো লেখা নামাতে পারেন। আর এই নামানোর হার দিন দিন বাড়ছে।’
প্রশ্ন যখন আবেগের
কিন্তু অনেক পাঠক ও লেখক একবাক্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এ ধরনের ডিজিটাল লেখায় সাধারণ কাগজে লেখা বইয়ের অনুভুতি প্রকাশ পায় না। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক অরহান পামুক তাঁর নিজের ইস্তাম্বুল পাঠাগারে ৭০ হাজারের মতো বৃহৎ গ্রন্থখন্ড সংগ্রহ করেছেন। তিনি এ কথায় সায় দিয়ে বলেন, ‘আমি যখন এই বর্তমান প্রযুক্তির মানের দিকে তাকাই, তখন একবাক্যে ই-রিডার ব্যবহারকে বলি, না। কিন্তু যেদিন এই প্রযুক্তির বই বিশেষত পুরোনো বইয়ের সেই সৌরভ সৃষ্টি করতে পারবে, তখন হয়তোবা বলব, হ্যাঁ।’
এখন দেখার বিষয় হলো ই-রিডারের ই-বই আসলেই কি হটিয়ে দিতে পারবে এত দিন ধরে কালজয়ী আবেগ সৃষ্টিকারী কাগজে লেখা বইকে? ভবিষ্যৎই বলে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর।
রয়টার্স অবলম্বনে